এবিএনএ : পার্থিব জীবনের সমাপ্তি টেনে সবাইকে পরকালীন জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে। পার্থিব ও পরকালীন জীবনের মেলবিন্দুর নাম মৃত্যু। মৃত্যু যেমন অনিবার্য, মৃত্যুর যন্ত্রণাও অবধারিত। যদিও বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মৃত্যু যন্ত্রণা সমান হবে না। অবধারিত মৃত্যুযন্ত্রণার প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ হয়েছে, ‘জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর যন্ত্রণা অনেক কঠিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫১০)
কোরআনের বর্ণনায় মৃত্যুযন্ত্রণা
পবিত্র কোরআনের চারটি আয়াতে স্পষ্টভাবে মৃত্যুযন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। তা হলো—
১. মৃত্যুযন্ত্রণা অনিবার্য : আল্লাহ বলেন, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৯) কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় মৃত্যু ও মৃত্যুযন্ত্রণা অনিবার্য। মুমিন ব্যক্তি মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে হয়তো তার গুনাহ মাফের জন্য অথবা মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। আর অবিশ্বাসীদের মৃত্যুযন্ত্রণা হয় পরবর্তী জীবনের শাস্তির সূচনা হিসেবে।
২. অবিশ্বাসীদের জন্য ভয়ংকর মৃত্যুযন্ত্রণা : আল্লাহ বলেন, ‘যদি তুমি দেখতে পেতে যখন অবিচারকারীরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের করো। তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্পর্কে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে। সে জন্য আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৯৩) উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারী ও পাপিষ্ঠদের মৃত্যুযন্ত্রণার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। আলেমরা বলেন, মৃত্যুযন্ত্রণা অবিশ্বাসীদের সেভাবে নাড়িয়ে দেয় যেমন সমুদ্রের ঢেউ ফেনাকে নাড়িয়ে দেয়।
৩. মৃত্যুযন্ত্রণার কাছে মানুষ অসহায় : ইরশাদ হয়েছে, ‘উপরন্তু কেন নয়—প্রাণ যখন কণ্ঠাগত হয় এবং তখন তোমরা তাকিয়ে থাকো।’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত : ৮৩-৮৪) উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ মৃত্যুযন্ত্রণার একটি সাধারণ চিত্র অঙ্কন করেছেন। যেখানে মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। যেন বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা নিজেদের অবস্থা লক্ষ করো। যখন জীবন তোমাদের কণ্ঠনালিতে চলে আসে এবং তোমরা কঠিন অবস্থায় পতিত হও, তখন তোমাদের আপনজনরা পাশে থেকেও কোনো উপকার করতে পারে না।
৪. মৃত্যুযন্ত্রণা মৃত্যুর বার্তাবাহক : আল্লাহ বলেন, ‘কখনো নয়, যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে এবং বলা হবে, কে তাকে রক্ষা করবে? তখন তার প্রত্যয় হবে যে এটা বিদায়ক্ষণ এবং পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাবে। সেদিন তোমার প্রভুর কাছে সব কিছু প্রত্যানীত হবে।’ (সুরা কিয়ামা, আয়াত : ২৬-৩০) এ আয়াতের ভাষ্য দ্বারা বোঝা যায়, মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যমেই বুঝতে পারবে মৃত্যু সমাগত, বুঝতে পারবে তার পরবর্তী জীবনের পরিণাম কী হবে।
মুমিন ও পাপী উভয়ের জন্যই মৃত্যুযন্ত্রণা
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় মুমিন ও পাপী সবাই মৃত্যুযন্ত্রণার শিকার হবে। পাপীদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করে তাদের প্রাণহরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ কোরো।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৫০) অন্যদিকে কোরআনে একজন মুমিনের মৃত্যুর দৃশ্য এভাবে তুলে ধরা হয়—‘তাকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলে উঠল, হায় আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারত—কিভাবে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ২৬-২৭)
সবচেয়ে কম মৃত্যুযন্ত্রণা হবে শহীদের
অবিশ্বাসী ও পাপীদের তুলনায় মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই হালকা হবে। আর সবচেয়ে কম মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবে আল্লাহর রাস্তার শহীদরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কাউকে পিঁপড়া কামড়ালে যতটুকু কষ্ট অনুভব করো, শহীদের নিহত হওয়ার কষ্ট তার চেয়ে বেশি হবে না।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩১৬১)
মুমিনের মৃত্যুকষ্ট কেন হয়?
একাধিক বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মৃত্যুর সময় মহানবী (সা.)-এর শারীরিক কষ্ট হয়েছিল। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি একটি পানিভর্তি বাটি তার সামনে রাখা ছিল। তিনি সেই বাটিতে তার হাত প্রবেশ করাচ্ছিলেন এবং পানি দিয়ে তার মুখমণ্ডল মলছিলেন। আর বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৭৮)
কিন্তু মুমিনের কেন মৃত্যুর সময় কষ্ট হয়। এ বিষয়ে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আয়েশা (রা.)-এর কাছে উপস্থিত হন। তখন তাঁর এক নিকটতম প্রতিবেশী মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। নবী (সা.) তাকে চিন্তিত দেখে বলেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর কারণে তুমি চিন্তিত হয়ো না। কেননা এটা সৎকর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪৫১)
এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা তার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো মুমিনের জন্য কোনো মর্যাদার স্তর নির্ধারণ করেন এবং নিজ আমল দ্বারা যদি তা অর্জন করতে না পারে, তখন আল্লাহ তাঁর শরীর বা তাঁর সম্পদ অথবা তাঁর সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর মুমিন ধৈর্যধারণ করার ফলে সে পূর্বনির্ধারিত মর্যাদার স্তরে পৌঁছে যায়।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩০৯০)
যে দোয়ায় মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হয়
মৃত্যুশয্যায় মহানবী (সা.) মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হওয়ার জন্য দুটি দোয়া করেন। তা হলো—ক. ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৭৮) খ. ‘হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করুন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬৭৪) আল্লাহ সবাইকে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা